পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-৭)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:০১:১৪ সন্ধ্যা
আমার বাবু!
খালিশপুরের এক রুমের বাসায় আমাদের জীবন চলছিল না চলার মত।
একজন স্কুল শিক্ষক স্বল্প বেতনে দুই ছেলেকে নিয়ে শহরের নতুন জীবনে টানাপোড়েনে পড়লেন। মা বাবার সাথে ছিলেন ছায়া হয়ে- ছিলেন দু'ভাবে। কখনো সংসারে আমাদের ওপর বাবার ছায়া হয়ে। কখনো তপ্ত জীবনের কড়া আঁচ থেকে বাবা সহ আমাদের তিনজনকে আড়াল করার ছায়া হয়ে । এখন ভাবলেই আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হই, সেই দুর্দিনে মায়ের ভালবাসার প্রলেপ আশেপাশের ভাড়াটিয়াদের বাঁকা চোখে দেখা আর তাদের কথায় আচরণে দেয়া তীব্র কষ্টের কষাঘাতে আমাদের তিনজনের হৃদয়ে যত কষ্টের দাগ পড়তো - সব মুছে দিত।
বাবা যে স্কুলে শিক্ষকতা করান, আমাকে সেখানে ক্লাশ থ্রিতে ভর্তি করে দেয়া হল আর আমার ছোট ভাই বাদলকে ওয়ানে। দুই ভাই এক সাথে স্কুলে যেতাম। অন্যান্য ছেলেমেয়েদের ভিতর থেকে আমাদেরকে সহজেই চেনা যেতো। এটা এজন্য নয় যে, আমরা বিশেষ কিছু ছিলাম বরং চরম দারিদ্র্যর জন্য চেনা যেতো। আমরা এক বিশেষ শ্রেণীর ছিলাম। সেই জন্যই আমাদেরকে চেনা যেতো। আমাদের পোশাক ছিল অন্যদের তুলনায় বিবর্ণ। শহরে আসার পরে বাবা আমাদের জন্য নতুন কিছু কিনে দিতে পারে নাই। স্কুল ড্রেসটা কোনোমতে দুই ভাইয়ের জন্য মা নিজের হাতে জোড়াতালি লাগিয়ে করে দিয়েছিলেন। পুরনো বই অন্যদের থেকে একেবারে কম দামে কেনা হয়েছিল। মোটকথা আমাদের বাবার প্রতি গ্রামে থাকতে আমার ভিতরে যে ভালোবাসা ও তার সক্ষমতায় গর্ব ছিল, সেটা হঠাৎ দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করল। আমার তখন আর কতটুকুই বুঝবার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু 'অন্যদের আছে, আমার নেই কেন?' এই অনুচ্চারিত প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি মায়ের কাছে বায়না ধরতাম- ভালো স্কুল ড্রেসের, ভালো জুতোর, রঙ্গীন পেন্সিলের, সুগন্ধি রাবারের, আর টিফিন দেবার জন্য। অন্যরা নিয়ে যেতো, আমরা দু ভাই - ওরা যখন খেত তখন মাঠের ভিতরে দৌড়াতাম কিংবা দুষ্টুমির ভিতরেই ওদের খাওয়া দেখে দেখে জিভের জল গিলে ফেলতাম। সেই সাথে কচি মনের হতাশাকেও কি?
চারিদিকে শুধু নাই নাই আর নাই। কিন্তু কেন??
আমার প্রিয় বাবু!
তোমার বাবা হিসাবে আমি তোমার আরামের জন্য খুব চেষ্টা করেছি। এরকম করুণ পরিবেশে তোমাকে থাকতে হয় নাই। কিন্তু আমার বাবার সাথে শহরজীবনের প্রথম দিকে - আমাদের জীবনের নতুন শুরুর জীবনের কথা বলছি, ইটপাথরের নগর জীবনের কথা বলছি, সেখানে অনেক কষ্ট পেয়েছি, হীনমন্যতায় ভুগেছি। যা আজ তুমি কলপনাও করতে পারবে না। তবে তোমার দাদু আমাদেরকে নিজের হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু পূরণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু সেই সময়ের ঐ সব অপূর্ণতার দাগ- না পাওয়ার বেদনা আজ বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছি, কষ্টগুলোও আরো তীব্র হয়েছে, সেই সময়ের একজন বাবার অক্ষমতার জন্য, একজন মায়ের হৃদয়ের গুমরে চলা নীল বিষাদের তীব্র আক্ষেপের জন্য, যা তিনি কারো সাথেই শেয়ার করতে পারেন নাই।
তখন টেলিভিশন ছিল খুবই কম বাসায়। রুপা যদিও আমার বন্ধু ছিল, কিন্তু ওদের বাসায় কখনো টিভি দেখতে যেতাম না। আমার কি রুপার প্রতি সেই ছেলেবেলায়ই কোনো ধরণের দুর্বলতা তৈরী হয়েছিল? নিজেদের গরিবী হাল কি ওদের আভিজাত্যের উজ্জ্বল চাকচিক্যের সামনে নুয়ে পড়তে চেয়েছিল? আমি ঠিক বলতে পারব না। ঐ বয়সে এক ধরণের ভালোলাগা তৈরী হয়েছিল, তবে সেটা আমার অবচেতন মনে।
মিথিলা বাবু!
এক বাসায় টিভি দেখতে গিয়ে একদিন কী হয়েছিল বলি। বাবা স্কুলে থাকতেন সেই বিকেল পর্যন্ত। আমরা নিচু ক্লাশে থাকায় আমাদের আগে ছুটি হয়ে যেতো। বাবার আসতে আসতে প্রায় ই শেষ বিকেল হয়ে যেতো। স্কুল থেকে এসে আমি আর বাদল আমাদের থেকে একটু দূরে এক বাসার জানালার গ্রীল ধরে অন্য বাচ্চাদের সাথে টিভি দেখতাম। আর এই বাসাটা ছিল বাবার আসার পথের ধারে। একদিন এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিভি দেখছিলাম। সেদিন একা ছিলাম। বাদল ছিল না। ঐ বাসার ছেলেটা, যে ছিল খুবই হিংসুটে এবং দুরন্ত, আমার মাথায় জানালা দিয়ে পানি ফেলে দিলো। আমি সম্পুর্ণ ভিজে গেলাম। আমার পাশে জানালা দিয়ে টিভি দেখতে যাওয়া অন্য ছেলেগুলো ঐ দুরন্ত ছেলেটার সাথে হি হি করে হেসে উঠল আমার দুরবস্থা দেখে। প্রচন্ড রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেল। সেই একশোটা চুলা দপ করে একসাথে জ্বলে উঠল। সেই মূহুর্তে আমার চোখগুলি যদি কেউ দেখতো! আমার মনের, আমার ব্রেইনের চেহারাটা যদি ওদের দেখার সামর্থ্য থাকতো! কিন্তু 'টিভিটা ওদের, জানালাটাও ওদের ' কথাটা ওই ছেলেটার ফেলা পানির চেয়ে বেশী ভিজিয়ে ফেললো আমার রাগটাকে। এই টিভি, এই জানালা আমার না। রাগ দেখালে পরে আর টিভি দেখতে আসতে পারবোনা। এত কষ্ট লাগল! অন্য অনেক ছেলের মত রাগারাগি মারপিট করতে পারলে হয়তো কিছু কষ্ট কমতো। তা তো হবার ছিল না। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। আমার চেতনায় তখন আমার পাশের ছেলেদের মুখের ছবি। ঐ ছেলেটির থেকে আমার সাথে যারা জানালা দিয়ে টিভি দেখছিল ওদের হাসিটা খুব কষ্ট দিচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল- আমি এবং ওরা সবাই ই তো একই রকম অবস্থার। তবে ওরা আমার এই অবস্থায় কেন হাসল? আমার গায়ে পানিটা পড়েছে, ওদের গায়ে পড়েনি বলে? আমার সাথে যা হয়েছে , একই জিনিস তো ওদের সাথেও হতে পারত!
মিথিলা বাবু!
ঐ বয়সেই আমাদের এই দেশের জনগণের চরিত্রের একটি বিশেষ দিক আমার চোখে ধরা পড়েছিল। এরা নিজেরদেরকে অন্যের ভিতরে দেখতে অভ্যস্ত নয়। অন্যের দুরবস্থায় শুধু হেসেই যায়। আর ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতার দম্ভে প্রচ্ছন্ন সায় দিয়ে যায়। অন্যের ক্ষমতার ভাগ প্রাপ্য নয় তবু ভোগ করা। নিজেকে ক্ষমতাবানদের দলের বলে কল্পনা করা। মানুষের এই মানসিক বিভক্তি ই ঐ সব শোষক শ্রেণীকে তাদের সকলের উপরে সামন্তসুলভ আচরন করতে সাহায্য করে। সেদিন ঠিক ঐ সময়ে বাবা বাসায় ফিরছিলেন। তিনি আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছু দেখলেন। মাথা নিচু করে থাকা আমাকে দেখলেন। আস্তে করে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি তার সাথে বাসায় ফিরে চললাম। অন্য বাবারা হতো এই ঘটনায় তীব্রভাবে রিয়্যাক্ট করতেন। কিন্তু বাবা আমাকে নিয়ে বাসায় এলেন, আমাকে সুন্দরভাবে শরীর মুছিয়ে দিলেন। আর বললেন, ' তোমার মাথা নিচু করে থাকবার তো কোনো দরকার ছিল না। অন্যায় ছেলেটি করেছে, তুমি কেন লজ্জা পাচ্ছিলে?' আমি অতো কিছু না বুঝে বাবাকে বললাম, ' আমরা কি খুব গরীব, বাবা?' এক মুহুর্ত থেমে আমার দিকে পরম মমতায় তাকালেন। বললেন, 'গরীব বলতে তুমি ঠিক কি বুঝাতে চাইছ বাবা, আমি জানি না। কিন্তু আমাদের এই অবস্থা সাময়িক। এটা দ্রুত কেটে যাবে। তবে মনে রাখবে, বাইরের দিক থেকে তুমি নিজেকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত ভাবছ হয়ত, কিন্তু মনের দিক থেকে কখনো নিজেকে গরীব বা বঞ্চিত ভাববে না।'
মিথিলা বাবু!
আজও আমার সেই দিনটির কথা মনে আছে। আমি বাবার সামনে। ওনার হাতে একটি গামছা, সেটায় পরম মমতা মেখে আছে। একজন বাবার হৃদয়ের নির্যাস-ভালোবাসার উষ্ণ পরশ। সেই একরুমের ঘরটিতে ভালবাসার উড়াল পংখিরা নিজেদেরকে বিছিয়ে দিয়েছিল। আমি সেই থেকে নিজেকে কখনো গরীব বা বঞ্চিত না ভাবার সংকল্প করেছিলাম, অনেকটা না বুঝেই। কিন্তু আদৌ সেটা কি পেরেছিলাম?
এরপর বাবা স্কুলের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে একটি সরকারি চাকুরিতে কেরানি পদে ঢুকেন। আমরা নতুন জায়গায় চলে গেলাম। রুপার সাথে আমার এখানেই বিচ্ছেদ হয়।
একটা বড় সমস্যায় পড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বাবার শিক্ষকতার মত মহান পেশা ছেড়ে চাকুরির গোলামীর জোয়াল কাঁধে নিতে হয়। ব্যাপারটা অনেকটা গ্রামের চেয়ারম্যানদের সাথে হওয়া ঘটনাটা রিপিট হওয়ার মতই। দুই একজন শিক্ষক কয়েক ছাত্রের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় অন্যায়ভাবে কিছু বাড়তি নাম্বার যোগ করেন আর সেই ছাত্রদের গার্জিয়ানের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করেন। এটা বাবা মানতে পারেন না। প্রতিবাদ করতেই শিক্ষকদের মধ্যে দুই দল হয়ে যায়। বিশ্রী কথা কাটাকাটি এক সময় হাতাহাতিতে গড়ায়। এক সময় প্রধানশিক্ষক ওই শিক্ষকের পক্ষ নেন। এরপর থেকে প্রধানশিক্ষক এর দেয়া সাহসে ওই শিক্ষক আর তার পক্ষ নেয়া সব শিক্ষক এক যোগে বাবা আর তাকে সমর্থন করা শিক্ষকদের শত্রু হয়ে দাঁড়ান। সবার সাথে সম্পর্কের মত মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাবার পক্ষে আর ক্লাস নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। বাবা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। এদিকে মুদি দোকানের বাকী শোধ করতে না পারা, ঈদের সময়ে ছেলেমেয়েদের জন্য সেরকম কিছু করতে না পারা, পাশের ভাড়াটিয়াদের সাথে সমস্যা, আর ওই এলাকাটা কিছুটা নিজের ছেলেদের ভবিষ্যতের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে এইসব অনেক কিছু ভেবে বাবা মায়ের সাথে পরামর্শ করে চাকরি আর বসবাসের এলাকা দুটোই বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন। আয়ের একমাত্র রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে নতুন চাকরিতে থিতু হওয়া পর্যন্ত সময়টুকুর জন্য এই পরিবারটির উপরে ঘোর অমানিশা নেমে আসে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১০০ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমার ঠিক জানা নেই, কেন এত কষ্ট।
শুভেচ্ছা রইলো।
এই উপদেশটা সবার মনে রাখা উচিত। লেখায় নতুন করে কিছু বলার নেই। যা অনুভূতি ছিল তাতো সব আগেই আপনাকে দিয়ে দিয়েছি তাই আর দেওয়ার মত কিছু নেই।
আপনার গভীর নান্দনিক অনুভূতি সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
শুভকামনা রইলো নিরন্তর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ভালো লাগার চিহ্ন রেখে গেলাম!
ভালো লাগার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
সম্পদের প্রাচুর্য্যতা কে ছাড়িয়ে যায় মনের প্রাচুর্য্য!শৈশব-কৈশোরে কথাটা বুঝতে না পারলেও পরিণত বয়সে ঠিকই উপলব্ধিতে আসে তা!
বরাবরের মতই বর্ণনার নান্দনিকতায় মুগ্ধ হলাম!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান!!
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
এই উপদেশ টা অনেক মূল্যবান। আপনার হৃদয়স্পশী লিখা পড়ে সবসময় মুগ্ব্দ হই এবার তার বাত্রিম নয়।অনেক ধন্যবাদ ও যাযাকাল্লাহ।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন